
আইসক্রিম শব্দটি মূল শব্দ হলেও দেশে দেশে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, যেমন “হিমায়িত কাষ্টার্ড”, “হিমায়িত দই”,“শরবত”, “গিলাতো”, “মালাই” ইত্যাদি। আবার অনেক দেশে আইসক্রিম শব্দটিকে অক্ষরের বেশ কম করে ভিন্নভাবে উচ্চারণ করা হয়। আইসক্রিম এর প্রধান উপাদান হচ্ছে বরফ, সেজন্য এটা খাওয়ার পর সর্দিতে আক্রান্ত হবার ভয় থাকে।

হাজার বছর ধরে প্রাচীন সভ্যতাগুলো ঠাণ্ডা খাবার হিসেবে বরফকে ব্যবহার করতো। বিবিসি’র এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২০০ বছর আগে চীনারা বরফের সাথে চাল ও দুধ মিশিয়ে ঠাণ্ডা খাবার তৈরি করতো। আইসক্রিমের আরও একটি ইতিহাস এই যে, ৩৭ থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমের সম্রাট নিরো এক সন্ধ্যায় তিনি তার দাস-দাসীকে সঙ্গে নিয়ে বেহালা বাজাচ্ছিলেন। সময়টি ছিল গ্রীষ্মকাল। হঠাৎ তার ঠাণ্ডা খেতে ইচ্ছা হলো। তাই শুনে দাস-দাসীরা ছুটে গেল পাহাড়ের চূড়ায়। সেখান থেকে বরফ সংগ্রহ করে তার সঙ্গে মধু আর ফলের রস মিশিয়ে সম্রাটকে খেতে দিল। সম্রাট মিষ্টি বরফ পেয়ে খুব খুশি হলেন এবং দাস-দাসীদের পুরস্কৃত করলেন। এরপর গরমকাল এলেই সম্রাট নিরোর জন্য এই মিষ্টি বরফ বানানো হতো।
আরবের মুসলমানরাই সর্বপ্রথম আইসক্রিমের প্রধান উপাদান হিসেবে দুধকে ব্যবহার করেন। তারা আইসক্রিমকে মিষ্টি করতো ফলের চেয়ে বেশী চিনি ব্যবহার করে। এবং তারাই সর্বপ্রথম আইসক্রিমের আধুনিক যুগের আবির্ভাব ঘটান এবং বাণিজ্যিকভাবে প্রসারেরও সূচনা করেন। ১০ম শতাব্দীর দিকে আরবের প্রধান শহরগুলোতে যেমন বাগদাদ, দামেস্ক এবং কায়রোয় আইসক্রিম ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারা বাণিজ্যিক আইসক্রিমগুলো তৈরি করতো বরফ, ক্রিম, বাদাম, দুধ, গোলাপ পানি, শুকনো ফল ইত্যাদি দ্বারা। Maguelonne Toussaint তার “A History of Food” গ্রন্থে লিখেছেন, সম্ভবত চীনাদের শরবত ও আইসক্রিম তৈরির একটি যন্ত্র তৈরির কৃতিত্ব রয়েছে। তারা ভরাট কন্টেইনারে সিরাপের সাথে বরফ ও যবক্ষার মিশ্রণ ঢালতো। যাতে লবণের মতোই পানির স্ফুটনাংক শূন্যের কোটায় নেমে যায়। কিছু বিকৃত ইতিহাস এই যে, ৯৬০-১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনার সং বংশের সম্রাট ইয়াং জং এর সময়ে ইয়াং ওয়ানলি নামক এক কবিরOde to the ice cheese "詠冰酪" (গীতিকাব্য বরফ পনির থেকে) নামক কবিতায় আইসক্রিমের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে প্রকৃত কবিতাটির নাম ছিল Ode to the pastry (গীতিকাব্য প্যাস্ট্রি থেকে)। প্যাস্ট্রি এক ধরনের পাশ্চাত্যের খাবার যা আইসক্রিম নয়। আইসক্রিমের আরও একটি ইতিহাস এই যে, ১২৬০ সালের দিকে ভারতের দিল্লীতে আইসক্রিমের প্রচলন শুরু হয়। তখন ভারতের মুঘল শাসক গন আইসক্রিম খেতেন এবং এটিকে পছন্দ করতেন। তারা দিল্লীর হিন্দুকুশ থেকে ঘোড়ায় করে বরফ আনয়ন করতেন। সেখানে বরফ দিয়ে শরবত তৈরি করা হতো।
মঙ্গোলীয় শাসক কুবলাই খান এর রাজত্বকালে তার সাম্রাজ্যে আইসক্রিম ব্যাপক জনপ্রিয় খাদ্য হয়ে উঠে। কুবলাই খান জানতে পারেন যে, তার রাজ্যে আইসক্রিম নামের একটি উপাদেয় খাদ্য তৈরি হচ্ছে। তখন তিনি খাদ্যটি ক্রয় করে নিয়ে আসতে বলেন। খাবারটি তিনি খাবার পর খুবই পছন্দ করেন। তাই তিনি ঘোষণা করেন, এ খবর যেন পড়শি রাজারা জানতে না পারে। কেননা তিনি চাননি এরকম একটি মজাদার খাবারের কথা অন্য কেউ জেনে যাক। কিন্তু কুবলাই খান না চাইলে কি হবে, এই মজার খাবারের কথাটি চাপা থাকে নি। ঠিক সে সময় জাহাজে চড়ে বিশ্ব প্রদক্ষিণ করতে বেরিয়েছিলেন বিখ্যাত পর্যটক মার্কোপোলো। চীন পর্যন্ত জাহাজে আসার পর পায়ে হেটে বিখ্যাত গোবি মরুভূমি অতিক্রম করার পর মার্কোপোলো যখন মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যে এসে উপস্থিত হন তখন তারও সৌভাগ্য হয় সুমিষ্ট বরফ খাওয়ার। তিনিও এই বরফখেয়ে মুগ্ধ হন। ঠাণ্ডা সুমিষ্ট বরফ খণ্ড তার এতই ভালো লাগে যে, তিনি এর তৈরি প্রণালী জানার ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শেষপর্যন্ত সফলও হন তিনি। ফেরার পথে তাই এই মজার বরফ তৈরির উপকরণ ও প্রস্তুতপ্রণালী সঙ্গে নিয়ে যান।দেশে ফিরে গিয়ে মার্কোপোলো খাবারটি তৈরি করলেন এবং সবার কাছে প্রশংসিত হন।
১৫৩৩ সালে যখন ক্যাথরিন দে মেডিসি ডিউক ওর্লিন্সকে বিবাহ করেন তখন তিনি তার সাথে কিছু খাবার ফ্রান্স থেকে আনার কথা বলেন। যার মধ্যে ছিল শরবত ও আইসক্রিম। একশত বছর পর ইংল্যান্ডের প্রথম চার্লস আইসক্রিম সৃষ্টিকর্তাদের আইসক্রিম তৈরির গোপন রহস্য প্রকাশ না করার জন্য আজীবন পেনশন দেবার ব্যবস্থা করেন। যাতে আইসক্রিম একটি রাজকীয় খাবার এ পরিণত হয়। কিন্তু তারপরও সাধারণের মাঝে আইসক্রিম তৈরির চেষ্টা বন্ধ হয়নি। ফলে দেশে দেশে খুব দ্রুত আইসক্রিম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা আইসক্রিম তৈরির জন্য বরফের সঙ্গে শুধু ক্রিমই মিশাতোতা নয়। বরং খাবারটিকে সুস্বাদু করে তোলার জন্য বিভিন্ন উপাদান মেশানো হতো। এর মধ্যে মধু, ফুলের রস, মাখন প্রভৃতি। এভাবেই ক্রিম আইস দিয়ে বরফের খাবার তৈরি হতে থাকল। ধীরে ধীরে 'ক্রিম আইস' নামটি হয়ে গেল আইসক্রিম।আর এভাবেই আইসক্রিম ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বের প্রতিটি দেশে দেশে। ১৮৫১ সালে বাণিজ্যিকভাবে আইসক্রিমের প্রথম দোকান দেন কার্লো গ্যাটি নামক একজন সুইস-ইতালিয়ান ব্যবসায়ী। ১৯০০ সালের দিকে এসে আইসক্রিম বিশ্বব্যাপী দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আইসক্রিমের দেশে দেশে কিছু ভিন্ন নামও আছে, যথা মালয়েশিয়া ও সিংগাপুরে “ইস কাচাং”, তুরস্কে “দনদোরমা”, ইতালিতে “গিলাতো”, ফিলিপাইনে “হালো হালো”, দক্ষিণ এশিয়ায় “কুলফি”, ভারত ও বাংলাদেশে “মালাই”ইত্যাদি।
আইসক্রিম তার উদ্ভব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেক বিস্তার লাভ করেছে। সেই সাথে আইসক্রিমে এসেছে অনেক আধুনিকতা ও নতুনত্ব। ধারনা করা হয় সামনের সময়ে এটি আরও প্রসার লাভ করবে।
------------সংগ্রহকৃত।
Comments
Post a Comment